তিতুমীর কলেজ প্রতিনিধি: রাজনীতির পালাবদলে আজ তিতুমীর কলেজের ছাত্রী হলগুলো অনেকটাই শান্ত। অথচ অতীতের কথা ভাবলেই অনেক শিক্ষার্থীর মনে পড়ে দাপুটে কিছু মুখের কথা-যাঁরা ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের নেত্রী। দল আজ ক্ষমতার বাইরে, জুলাই আন্দোলনের পর পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। সেই সঙ্গে অদৃশ্য হয়ে গেছেন হল জীবনের ‘ক্ষমতাধর’ কয়েকজন।
তৎকালীন সময়ে সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসে অবস্থান করতেন উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক সাবিকুন্নাহার মুক্তা ও সহ-সম্পাদক বনলতা বিউটি। সিরাজ ছাত্রীনিবাসে অবস্থান করতেন উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক মোহিনী আক্তার এবং অপরাজিতা ছাত্রীনিবাসে থাকতেন ছাত্রলীগের ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক তাহসিনা আক্তার অতিথি ও উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক খাদিজা আক্তার রাফিন।
যে যেই হলে থাকতেন, সেই হল পরিচালনার দায়িত্ব ছিল তার। ছাত্রীনিবাসে শিক্ষক নন, সর্বেসর্বা ছিলেন এই নেত্রীরা। ক্ষমতার দাপটে প্রশাসনও তখন ছিল নিশ্চুপ, এমনটাই অভিযোগ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের। ছাত্রীনিবাসের শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘যেখানে ছাত্রীনিবাসের সকল দায়দায়িত্ব কলেজ প্রশাসনের ওপর বর্তায়, সেখানে হল কর্তৃপক্ষ দায়িত্বে থেকেও নিষ্ক্রিয় ছিলেন।’
ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এই নেত্রীরা বিভিন্ন সময়ে হলে নানা ধরনের 'সিন্ডিকেট' করতেন বলে ক্ষোভ শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ মতে, 'প্রতি সিটে দুজন করে থাকার নিয়ম থাকলেও নেত্রীরা থাকতেন একাই। এছাড়াও অবৈধভাবে বেশি টাকার বিনিময়ে ছাত্রীদের সিট নিয়ে দেওয়া ছিল তাদের অন্যতম ব্যবসা। তবে সেই সিট দেয়ার রশিদ কিংবা টাকা কোনো টাই পৌঁছাতো না হল কর্তৃপক্ষের কাছে। এছাড়াও নিজেদের হলের সেশন ফি না দেওয়া, রান্নাঘরের সকল সুযোগ-সুবিধা নিজেদের দখলে রাখা, ওয়াইফাই বিল বেশি নেওয়া, ক্যান্টিনের খাবারের বিল না দেওয়া ছিল রোজকার রুটিন।'
হলের শিক্ষার্থীরা বলেন, 'তৎকালীন ক্ষমতাসীন নেত্রীরা কেবল নিজেরা সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেই ক্ষান্ত হননি। বিভিন্ন সময়ে হলের শিক্ষার্থীদেরও করেছেন মানসিক ক্ষতি।' শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন, ‘যেকোনো সময় তুচ্ছ বিষয়ে মিটিং ডেকে অন্য শিক্ষার্থীদের হয়রানি করতেন। কেউ মিটিংয়ে না আসলে অথবা তাদের কথা না শুনলে করতেন অযথা হয়রানি, দিতেন হুমকি।’ এছাড়াও যারা হলে থাকতেন নানা সময় ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে থাকতে বল প্রয়োগ করা হতো, বলেও দুঃখ প্রকাশ করেন তারা।'
শিক্ষার্থীরা জানান, 'জুলাই আন্দোলনের সময় আন্দোলনে যোগ দিতে চাওয়ায় মেয়েদের ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি আসে তৎকালীন সুফিয়া হলের সাবিকুন্নাহার মুক্তার কাছ থেকে। সে সময় এই ঘটনার কোন ব্যবস্থা নেননি তৎকালীন সেই হলের দায়িত্বরত অধ্যাপক ফরিদা ইয়াসমিন।'
শুধু ছাত্রীনিবাস নয়, কলেজজুড়ে বিভিন্ন আয়োজনে ছাত্রলীগ নেত্রীদের দাপট ছিল দৃশ্যমান। বসন্ত বরণ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত পিঠা উৎসবে নানা বিভাগের শিক্ষার্থীরা অংশ নিলেও প্রথম পুরস্কার যায় ছাত্রলীগ নেত্রী অতিথির নেতৃত্বাধীন স্টলের ঝুলিতে। অংশগ্রহণকারী এক শিক্ষার্থী বলেন, 'পিঠার স্বাদ গড়পড়তা হলেও শুরু থেকেই গুঞ্জন ছিল, ছাত্রলীগ স্টলই পুরস্কার পাবে। ফলাফলও তাই হলো।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘তৎকালীন ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক খাদিজা আক্তার রাফিন অবৈধভাবে ইডেন কলেজের এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে অপরাজিতা হলে থাকতেন। এছাড়াও যারা গণরুমে ছিলেন তারা সর্বদা ছাত্রলীগ নেত্রীদের আদেশ মানতে একপ্রকার বাধ্য ছিল।’
জানা যায়, সেই ইডেন শিক্ষার্থী সম্পর্কে ছাত্রলীগ নেত্রী রাফিনের বোন। কিন্তু অন্য কলেজের শিক্ষার্থী হলে থাকার কোনো বৈধতাই নেই বলে স্পষ্ট বিধান রয়েছে। এ বিষয়ে ছাত্রলীগ নেত্রী রাফিনকে বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এছাড়াও নানা অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও, জুলাই আন্দোলনের পর থেকে অতিথি ও মুক্তার সিম বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, জুলাই আন্দোলন শেষে হল ছেড়ে যাওয়ার পর, বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন ছাত্রলীগ নেত্রী তাহসিনা আক্তার অতিথি। সহ-সম্পাদক বনলতা বিউটি পাঁচ আগস্টের পর ক্যাম্পাসে পা রাখলে, শিক্ষার্থীরা তাকে তুলে দেন পুলিশের হাতে। এছাড়াও খাদিজা আক্তার রাফিন ফিরে গেছেন পরিবারের কাছে। তবে সাবিকুন্নাহার মুক্তা কিংবা মোহিনী আক্তারের বিষয়ে, সুস্পষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের সাবেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সহ-সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহানাজ পারভীন বলেন, ‘আমার হল জীবনের শেষের দিকে হলে কয়েকজন মেয়ে ছাত্রলীগ শুরু করলেও তারা কখনো আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, সম্পাদকসহ বিভিন্ন নেতা আমাকে হল থেকে বের করে দেওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেছে। হলের কেয়ারটেকার কয়েকবার বলেছে, ‘আমার উপর অনেক চাপ আসছে, তুমি সকালে হল ছাড়বে।’ আমি বারবার ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের হেনস্তার শিকার হয়েছি। আমার সাথের ছোট ভাইদের মারধর করেছে তারা। আমি পরীক্ষা দিতে গেলে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ফোন কেড়ে নেওয়া হয়েছে...এ ধরনের ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন, 'হলের মেয়েদের ছাত্রলীগ নেত্রীরা যখন টর্চার শুরু করে, তখন আমার অনার্স শেষ হয়ে গিয়েছিল, আমি হল ছেড়ে দিয়ে ছিলাম। আমি চাই, বিগত দিনের মতো যেন আর কোনো জোর-জুলুম, মেয়েদের টর্চার না চলে। আমি অনেকবার বাধার সম্মুখীন হয়েছি। তাই আমি চাই আমার মতো, গণতান্ত্রিক দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চার ক্ষেত্রে কেউ যেন বাধাগ্রস্ত না হয়। গণতান্ত্রিক দেশে হল হোক বা অন্য কোথাও হোক, প্রত্যেকেই যেন নিজেদের অধিকার সচেতনতার জন্য; সুষ্ঠু রাজনৈতিক চর্চা করার সুযোগ পায়...সুষ্ঠু পরিবেশ পায়।'
ছাত্রলীগ নেত্রীদের এসব অপকর্মের ব্যবস্থা নেয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে, তৎকালীন সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসের হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, 'ছাত্রলীগ নেত্রীদের সাথে কোনোদিনই আমার ভালো সম্পর্ক ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তাদের এসব কর্মকাণ্ডে সচেতন করা হলেও তারা কখনোই শুনতো না। ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে তাদের কাছে প্রশাসন একপ্রকার অসহায় ছিল।'
সুফিয়া কামাল ছাত্রীনিবাসের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে হল তত্ত্বাবধায়ক সহযোগী অধ্যাপক রীতা খন্দকার ও সহকারী হল তত্ত্বাবধায়ক প্রভাষক এলমা আকতার ঈশিতা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে অপরাজিতা ছাত্রীনিবাসের তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক মোসা. মুর্শিদা জাহান বলেন, 'আমার জানা মতে হলে এখন ছাত্রলীগের কেউ নেই, যারা ছিল তারা চলে গেছে। আগের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমি অবগত নই, কারণ তখন দায়িত্বে ছিলাম না। এখন এক সিটে দুজন থাকে এবং নতুন কিছু নিয়ম চালু করেছি—যেমন রাত আটটার মধ্যে হলে ফিরতে হবে, হলে থেকে কেউ চাকরি করতে পারবে না।'
তিনি আরও জানান, ‘ক্যান্টিনের খাবারের মান উন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হল মেট্রন ও সহকারী তত্ত্বাবধায়ককে নিয়মিত মনিটরিংয়ের বিষয়ে বলা হয়েছে।' সার্বিকভাবে তিনি মনে করেন, 'পূর্বের তুলনায় পরিস্থিতি ভালো। তবে ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বদলাবে কিনা তা এখনই বলা সম্ভব নয়।’
সিরাজ ছাত্রীনিবাসের তত্ত্বাবধায়ক সহকারী অধ্যাপক আক্তার জাহান বলেন, ‘বর্তমান প্রেক্ষাপট ভালো। যতটা শক্ত থাকা যায় আমরা থাকছি। রাজনৈতিক প্রভাব, অহেতুক মিটিং, সিট বাণিজ্য এখন একেবারেই নেই। সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্যে যেন সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় থাকে, সেজন্য আমরা সচেষ্ট।’
ভবিষ্যতে হলে আবার রাজনৈতিক দখলদারিত্ব ফিরে আসতে পারে কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা পরিবেশের উপর নির্ভর করে। অগ্রিম কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে হলের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।’
তিতুমীর কলেজের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক আলা উদ্দিন মিনহাজ বলেন, ‘ছাত্রী হলগুলোতে নৈরাজ্য ছিল ফ্যাসিবাদের সময়। জুলাই আন্দোলনের পর আমরা প্রত্যাশা করেছি, প্রত্যেক হলে মেধা, দূরত্ব ও আর্থিক দিক বিবেচনায় সিট বরাদ্দ হবে। বর্তমানে কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, তবে সেটি কতদিন থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'হল প্রশাসনের প্রতি এখনও পুরোপুরি আস্থা রাখা যাচ্ছে না। বর্তমান অধ্যক্ষের নেতৃত্ব নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রশ্ন আছে। আমরা আশঙ্কা করছি, এই নেতৃত্বে হলে পূর্বের ন্যায় পরিবেশ আবার ফিরে আসতে পারে। কলেজ প্রশাসন যদি কার্যকর ও ন্যায়ভিত্তিক না হয়, তবে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।’
আলা উদ্দিন মিনহাজ বলেন, 'তবে আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, যেখানেই অন্যায় হবে-বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। সবসময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশে থাকব। এর জন্য যদি জীবনও দিতে হয়, তবু আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেব।'
তিতুমীর কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ছদরুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘বর্তমানে কলেজের পরিবেশ ভালো। আমি বিশ্বাস করি, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক দলগুলো শিক্ষা নিয়েছে। ভবিষ্যতে কেউই এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার দুঃসাহস দেখাবে না—এমনটাই আমার প্রত্যাশা। শুধু তিতুমীর কলেজ নয়, গোটা জাতির জন্য সুস্থ পরিবেশ বজায় থাকবে বলে আমি প্রত্যাশা করি।’
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available