নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশি সিনেমার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছিল ২০২১ সালের জুলাই মাসে, যখন বিশ্ব চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ মঞ্চে প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেয় বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব কান-এর মূল প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো জায়গা করে নেয়া বাংলাদেশি ছবির এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রথমবারের মতো শক্তভাবে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় বাংলা সিনেমা। সেই ইতিহাসের নেপথ্যের দলের অন্যতম সদস্য ‘নির্বাহী প্রযোজক এহসানুল হক বাবু’। এই নির্মাণযাত্রা তার জন্য ছিল যেমন কঠিন, তেমনি অপ্রতিরোধ্য।
চলচ্চিত্র শিল্পের প্রতি বাবুর আবেগ শৈশব থেকেই। হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে জীবনযাত্রার বাস্তবতায় কিছুটা দূরেই ছিলেন লাইট-ক্যামেরার দুনিয়া থেকে। তবে মন তো পড়ে ছিল ভিজ্যুয়ালের সীমানায়। বাবুর কথায়, “শেষ বলতে কিছু নেই, সব শেষ থেকেই নতুন শুরু”— সেই উপলব্ধি থেকেই ১৭ বছর আগে শুরু হয় তার মিডিয়া-ভবনের ইট-বালি সাজানো। কাজের পথচলা শুরু করেন দেশের শীর্ষ প্রোডাকশন হাউজগুলোর সাথে। এরমধ্যেই পরিচালক আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন নিজের প্রথম প্রোডাকশন হাউজ ‘খেলনা ছবি’। সেই থেকেই বিজ্ঞাপন, সিনেমার পথে যাত্রা। ‘প্রযোজক’ পরিচয়ে শুরু হয় নতুন পরিচয়ের পথচলার শুরু। শুরুটা ‘খেলনা ছবি’ দিয়ে হলেও পরবর্তীতে গড়ে তুলেন একে একে ৩ টি প্রোডাকশন হাউজ।
শুরু থেকেই ব্যস্ত ছিলেন বিজ্ঞাপন থেকে শুরু করে কর্মাশিয়াল নানান কাজ নিয়ে। সাহস রেখে ২০১৬ সালে নেমে যান সিনেমার কাজে। বাবুর প্রযোজিত প্রথম ছবি ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’র ঝুলিতে আছে নানান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, যার মধ্যে আছে সিঙ্গাপুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালক ও সেরা অভিনেতার পুরস্কার। পরে দেশে পায় মেরিল-প্রথম আলো শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের স্বীকৃতিও। কিন্তু এই অর্জন ছিলো শুধুই শুরু।
এরপর আসে সেই অভাবনীয় মুহূর্ত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। শুরুতে এটি ছিলো নির্মাতা সাদের ভাবনায়, সে থেকে গল্পে রূপান্তর করে সবাই মিলে নেমে যাওয়া। এক বছর ধরে রিহার্সাল, আড়াই মাসের শুটিং, সবই নিজস্ব অর্থায়নে। ছিলোনা বাহ্যিক কোনো বিনিয়োগ। “এই সিনেমার জন্য ব্যক্তিগত জিনিসপত্রও বিক্রি করেছি”— বললেন বাবু, যার প্রতিটি উচ্চারণেই ছিল শ্রম ও অনুভবের সম্মিলন। এত পরিশ্রমের ফলাফল? সে গল্পতো সবারই জানা। এত গল্পের ভীড়ে ৪ বছর পূর্ণের এই সময়ে আমরা জানতে চাইলাম বিশেষ কোনো মুহূর্তের কথা। বাবু যোগ করেন, “কান উৎসবে আমন্ত্রণ, স্ক্রিনিংয়ের শেষে দাঁড়িয়ে করতালি, পুরো টিমের কাছে সে মুহূর্তটাই ছিল স্বপ্নপূরণের, যেনো সব কষ্ট সার্থক।” ‘কান’ এর বাইরেও ছবিটি অংশ নেয় ২০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক উৎসবে। বৈশ্বিক দর্শকের এমন সাড়া দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন সকলেই, কারণ ছবিতে ছিল না গান, ছিল না গ্ল্যামার, ছিল কেবল একান্ত সত্যের অনুপুঙ্খ বয়ান।
কিন্তু কেন ‘রেহানা’র পর এত দীর্ঘ বিরতি? উত্তর একেবারেই বাস্তববাদী। বাবু বলেন, “আমরা আমাদের আয়ের টাকা জমিয়ে তবেই সিনেমা বানাই। যেহেতু আমাদের গল্পের বাণিজ্যিক চাহিদা কম, বিনিয়োগকারীরও অভাব। তাই নিজেই বিনিয়োগ করি। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ, কিন্তু তাতেই আমরা শান্তি খুঁজে পাই।”
তবে দীর্ঘ প্রস্তুতির ফসল ঘরে তোলার মতোই, ‘রেহানা’ টিমের পরবর্তী চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত। শীঘ্রই শুরু হবে শুটিং। এর বাইরেও ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে একটি ওয়েব সিরিজের কাজ, যা শীঘ্রই মুক্তি পাবে। প্রতিটি কাজেই প্রথমে থাকে উৎসবের পরিকল্পনা, তারপর বাণিজ্যিক চিন্তাভাবনা।”
‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ সিনেমার বাইরেও এহসানুল হক বাবুর আছে একঝাঁক ওয়েবসিরিজ, নাটকের কাজ। সে তালিকায় আছে ওয়েবফিল্ম ‘রেফিউজি’, ‘কলি ২.০’। নাটকে আছে ‘গল্পটা শেষ হয়ে গেল’, ‘বুকের ভিতর কিছু পাঁথর থাকা ভাল’, ইত্যাদি। এছাড়াও অর্ধহাজার বিজ্ঞাপনে ‘প্রযোজক’ পরিচয় তো আছেই!
‘প্রযোজক’ পরিচয়ে কাজের বাইরেও চলচ্চিত্র শিল্পের নানান কাঠামোগত অংশের সাথে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালনেও আছে এহসানুল হক বাবুর ব্যস্ততা। জুরি সদস্য হিসেবে পালন করে আসছেন নানান চলচ্চিত্র উৎসব ও প্রতিযোগীতায়। সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন ‘বাংলাদেশ ফিল্ম প্রডিউসারস অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউটরস অ্যাসোসিয়েশন’ এবং ‘বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাডভার্টাইজিং প্রডিউসারস’ এর সাথে।
শুধু প্রযোজক হিসেবে নন, স্টুডিও, ক্যামেরা ইত্যাদি চলচ্চিত্রমুখী উন্নয়ন সম্পর্কিত নানান ব্যবসার সাথেও জড়িত আছেন বাবু। গতানুগতিক ব্যবসার বাইরে চলচ্চিত্রের নির্মাণ ও নির্মাণ-পরবর্তী ধাপগুলোকে আরো পেশাদার ও মানসম্পন্ন করে তোলার উদ্যোগ নিয়ে আছে বাবুর দীর্ঘ পরিকল্পনা।
নতুন প্রজন্মের অনেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ খুঁজে পায়, ‘তাদের জন্য কী পরামর্শ?’ তার মতে, “প্রযোজনায় যুক্ত হতে চাইলে আগে চলচ্চিত্রকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। বুঝতে হবে প্রতিটি পর্যায়, প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনের কারণ। কেবল অর্থনৈতিক লাভের আশায় এই জগতে এলে খুব দ্রুত হতাশা নেমে আসে। তাই দরকার চলচ্চিত্রের প্রতি গভীর আগ্রহ, আত্মনিবেদন, আর সৎ রুচিবোধ।”
সবকিছুর ভীড়ে বাবুর লক্ষ্য এখনো স্পষ্ট, “একটি নতুন বাংলাদেশের চিত্র বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করা, যেখানে গল্পের সাথে দেশের পতাকা থাকবে গর্বিত সঙ্গী”।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available