বকশীগঞ্জ (জামালপুর) প্রতিনিধি: জামালপুর জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা বকশীগঞ্জের সূর্যনগর নঈমিয়ার হাট এখন একটি বিশেষ নামের সাথে পরিচিত যা মহিষের টক দইয়ের রাজ্য। দীর্ঘদিন ধরে এই হাটের দই স্থানীয়ভাবে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি আশেপাশের জেলাগুলোর মানুষের কাছেও এক অনন্য রসনার খোরাক হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় দই ক্রেতারা জানান, প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার এই হাট বসে, দুপুর থেকে শুরু হয় নঈমিয়ার হাটের দই বিক্রি। সারিসারি দইওয়ালা তাদের কাঁধে দই ভর্তি হাঁড়ি নিয়ে এসে বসেন বাজারের নির্দিষ্ট স্থানে। মাটির হাঁড়িতে জমা থাকে ঘন, টক আর একেবারে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করা দই, যা মূলত তাজা মহিষের দুধ থেকে প্রস্তুত হয়।
এই দই তৈরি হয় কোনো ধরনের কৃত্রিম রঙ বা রাসায়নিক ছাড়াই। নিজেদের গৃহপালিত মহিষের তাজা দুধ দহন করে একটু ঠান্ডা করে তাজা দুধ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবে ফারমেন্ট করে তৈরি হয় এই টক দই। এতে প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া থাকার কারণে এটি হজমে সহায়ক, পাশাপাশি এটি ক্যালসিয়াম, প্রোটিন ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে ভরপুর।
স্থানীয় দই বিক্রেতা ওয়ায়েজকুরুনী বলেন, আমাদের দই একেবারে মহিষের তাজা খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি হয়। কোনো ভেজাল নেই। কোনো রঙ বা কেমিক্যাল ছাড়াই মহিষের খাঁটি দুধ দিয়ে এই দই তৈরি করা হয়। প্রথমে মাটির হাঁড়ি ভালোভাবে পরিষ্কার করে হাঁড়িতে সামান্য পরিমাণ সরিষার তেল মেখে নিয়ে রোদ বা চুলার তাপে শুকিয়ে নিয়ে তাজা মহিষের দুধ ভালোভাবে ছাঁকনা দিয়ে ছেঁকে নিয়ে তারপর হাঁড়িতে রেখে দিতে হয়। ২০ থেকে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষার পর তা সুন্দর স্বাদের দই তৈরি হয়। একটি হাঁড়িতে ২ লিটার থেকে ১৫ লিটার পর্যন্ত দই বসানো যায়।
দই বিক্রেতা মোতালেব হোসেন বলেন, প্রতি হাটে এখানে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ কেজি দই বিক্রি হয়। মহিষের দই এই এলাকার একটি মজাদার খাদ্য যা একবার খেলে ক্রেতা বারবার ফিরে আসে। এই দইয়ের চাহিদাও অনেক। অনেক দুর দরান্ত থেকে লোকজন এসে এ বাজার থেকে দই ক্রয় করে নিয়ে যায়।
এই দই বিক্রির মাধ্যমে অসংখ্য পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছেন। তবে এ এলাকায় মহিষের কোনো খামার নেই, নিজেদের গৃহপালিত মহিষের দুধ থেকেই দই তৈরি করে বিক্রি করেন। একটি মহিষ দৈনিক চার থেকে আট কেজি দুধ দিয়ে থাকে। এতে নারী উদ্যোক্তারাও এগিয়ে এসেছেন। ঈদ, পূঁজা কিংবা বিয়ে যে কোনো উপলক্ষে এই দইয়ের চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যায়। প্রতি কেজি দই বিক্রি হয় ১২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা পর্যন্ত। এই দইয়ের চাহিদা রমজান মাসে ও ঈদে কয়েকগুণ বেড়ে যায় ফলে দামও অনেকটা বেশি হয়।
এই দই কেবল একটি খাবার নয়, এটি বকশীগঞ্জ বাসীর সংস্কৃতিরও অংশ। অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে খাবারের পর এক কাপ ঠান্ডা টক দই যেন পরিপূর্ণতা এনে দেয়। বকশীগঞ্জ, দেওয়ানগঞ্জসহ আশেপাশের উপজেলা ও গ্রাম থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ নঈমিয়ার হাটে এসে এই দই কিনে নিয়ে যান। কেউ কেউ আবার ঢাকায় আত্মীয়দের জন্য পাঠান এই দই।
স্থানীয়দের দাবি, এই দই শিল্পকে কেন্দ্র করে মানুষকে মহিষ পালনে উদ্বুদ্ধ করে একটি গ্রামীণ দই বাজার গড়ে তুললে এলাকার অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। দই প্রস্তুতকারীদের প্রশিক্ষণ, সংরক্ষণের আধুনিক ব্যবস্থা ও সরকারি সহায়তা পেলে এটি হতে পারে একটি জাতীয় ব্র্যান্ড।
সূর্যনগর নঈমিয়ার হাটের মহিষের টক দই শুধু খাবার নয়, এটি এক ধরনের ঐতিহ্য, এক টুকরো সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই স্বাদ একবার যারা পেয়েছেন, তারা ভুলে যান না সহজে।
বকশীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা ডা. মুহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, মহিষের টক দই একটি স্বাস্থ্যকর খাবার এর উপকারিতা অনেক যেমন, মহিষের দই উচ্চ প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ, মহিষের দুধে গরুর তুলনায় বেশি প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম থাকে, ফলে দইতেও এসব উপাদান বেশি থাকে। এটি হাড় ও দাঁতের গঠন মজবুত করে। এ দই হজমে অনেক সহায়ক, মহিষের টক দইয়ে থাকা প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া হজমশক্তি বাড়ায় এবং পেটের নানা সমস্যা যেমন গ্যাস, অ্যাসিডিটি ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, দইয়ে থাকা ল্যাক্টোব্যাসিলাস জাতীয় উপকারী ব্যাকটেরিয়া শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যদিও মহিষের দইয়ে চর্বির পরিমাণ বেশি, তবুও এটি খেলে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা অনুভব হয়, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়। এছাড়াও ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী, উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
তিনি আরও বলেন, মহিষের টক দইয়ের ক্ষতিকর দিক নেই বললেই চলে, ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সহনীয়, সঠিক পরিমাণে খেলে এটি রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ রাখতে সাহায্য করে। তবে ডায়াবেটিস রোগিদের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শে খাওয়াই উত্তম।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available